নবুওয়তের প্রাথমিক যুগে যে কয়েকজন কমবয়সী সাহাবি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্যে এসেছিলেন মিসওয়ার ইবনে মাখরামা (রা.) তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি ইসলামের ইতিহাস ও নবীজির জীবনের ঘটনাবলির একজন গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনাকারী।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে, বিশেষ করে নবীজির (সা.) জীবদ্দশা এবং পরবর্তী খলিফাদের শাসনামলে তিনি সাহসিকতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষত, রাজনৈতিক সংকট এবং যুদ্ধকালীন সময়ে তার পরামর্শ ও নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। হজরত উমর ও উসমানের (রা.) বিশেষ পরামর্শদাতাও ছিলেন মিসওয়ার ইবনে মাখরামা (রা.)। তিনি মোট ১২২টি হাদিস বর্ণনা করেছেন, যা বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে তার অবদান এবং হাদিস বর্ণনার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন।
পরিচিতি:
পুরো নাম: মিসওয়ার ইবনে মাখরামা ইবনে নওফাল ইবনে উহাইব ইবনে আবদ মানাফ ইবনে যুহরা ইবনে কিলাব কুরাইশী যুহরী মক্কী। মায়ের নাম ছিল শিফা বিনতে আওফ। কেউ বলেন, আতিকা বিনতে আওফ।
কুনিয়াত বা উপনাম: আবু আবদুল্লাহ। আবু আব্দুর রহমান।
উপজাতি: তিনি কুরাইশ বংশের বনি আবদুশ শামস শাখার অন্তর্ভুক্ত হিসেবে কুরাইশ গোত্রের একজন সদস্য ছিলেন।
জন্ম: হিজরতের আগে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন।
ইসলামের সাথে সম্পৃক্ততা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্যে:
মিসওয়ার ইবনে মাখরামাহ (রা.) ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্যে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। ছিলেন নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ঘনিষ্ঠ সাহাবীদের একজন। তিনি ইসলাম গ্রহণ পরবর্তী ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
তিনি হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিলেন এবং হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি এ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন।
বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি:
১. গভীর জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তা
মিসওয়ার (রা.) ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী ও দূরদর্শী ব্যক্তি। তিনি নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বিভিন্ন হাদিস সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও বর্ণনা করেন।
রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় বিষয়ে তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি ছিল, যা খলিফাদের পরামর্শদাতা হিসেবে তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সাহায্য করে।
২. ন্যায়পরায়ণতা
তিনি ন্যায়ের পক্ষে অটল ছিলেন এবং সত্য বলায় কখনও দ্বিধা করতেন না। তাঁর চিন্তাধারা ও কার্যক্রম সবসময় ইসলামের নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।
৩. বিনয় ও নম্রতা
মিসওয়ার (রা.) ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। তিনি নিজের মর্যাদার বিষয়ে কখনও অহংকার করেননি এবং মানুষের সেবা করার জন্য নিজেকে নিবেদন করেছিলেন।
৪. ধর্মনিষ্ঠতা ও আত্মনিবেদন
তিনি ইসলামের বিধান পালনে অত্যন্ত কঠোর ও ধর্মপ্রাণ ছিলেন।ইবাদত-বন্দেগি এবং আল্লাহর প্রতি তাঁর গভীর আনুগত্য ছিল প্রশংসনীয়।
৫. সাহস ও দায়িত্বশীলতা
ইসলামের প্রাথমিক যুগে, বিশেষ করে নবীজির (সা.) জীবদ্দশা এবং পরবর্তী খলিফাদের শাসনামলে তিনি সাহসিকতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন।
বিশেষত, রাজনৈতিক সংকট এবং যুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর পরামর্শ ও নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
৬. পরামর্শদাতা হিসেবে খ্যাতি
খলিফা উমর ইবন খাত্তাব (রা.) এবং উসমান ইবনে আফফান (রা.)-এর শাসনামলে তিনি বিশেষ পরামর্শদাতা ছিলেন। তাঁর উপদেশগুলো সবসময় সময়োপযোগী এবং ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক ছিল। তাঁর বুদ্ধিমত্তা এবং দূরদর্শিতা তাঁকে কুরাইশদের মাঝে বিশেষ মর্যাদা এনে দেয়।
৭. ঐতিহাসিক তথ্য সংরক্ষক
মিসওয়ার (রা.) ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও নবীজির জীবনের ঘটনাবলির একজন গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনাকারী। তাঁর বর্ণিত হাদিসগুলো সাহাবীদের জীবনধারা এবং ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচন করেছে।
৮. ত্যাগ ও সমর্পণ
তিনি নিজের ব্যক্তিগত জীবন এবং স্বার্থের চেয়ে ইসলামের মঙ্গল ও সম্প্রদায়ের উন্নতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি ইসলামের আদর্শকে ঊর্ধ্বে রাখতেন।
৯. পরিবার ও সামাজিক দায়িত্ব
তিনি ছিলেন একজন আদর্শ পরিবারপ্রধান। নিজের পরিবারের সঠিক পরিচালনা এবং সন্তানদের ইসলামের পথে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে ছিলেন অতুলনীয়।
সমাজে তাঁর ভূমিকা ছিল সক্রিয়, যেখানে তিনি সবার প্রতি সহানুভূতি ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন।
মোটকথা, মিসওয়ার ইবনে মাখরামা (রা.)-এর চরিত্রে গভীর বিশ্বাস, বুদ্ধিমত্তা, ন্যায়পরায়ণতা এবং ধর্মীয় আনুগত্যের এক অসাধারণ সমন্বয় দেখা যায়। তাঁর জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে মুসলিম উম্মাহ নিজেদের জীবন গঠনের পথ খুঁজে পেতে পারে।
হাদিস বর্ণনা ও অবদান:
তিনি মোট ১২২টি হাদিস বর্ণনা করেছেন, যা বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিম এবং অন্যান্য বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণ স্বীয় হাদিস গ্রন্থে মিসওয়ার রা. এর হাদীস বর্ণনা করেন। ইসলামের ইতিহাসে তার অবদান এবং হাদিস বর্ণনার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন।
তাঁর ব্যপারে হাদিস বিশারদ মনীষীদের বক্তব্য:
ইবনে সাআদ রহ. তার লিখিত আত তাবাকাতুল কাবীর (৬/৫২১) এ বলেন, রাসূল সা. ইন্তেকাল করেন এমতাবস্থায় যে, মিসওয়ার ইবনে মাখরামা রা. আট বছর বয়সী ছিলেন এবং নবীজী সা. থেকে অনেক হাদীসও মুখস্থ করেছিলেন।
ইমাম যাহাবী রাহ. স্বীয় গ্রন্থ আল কাশিফ (২/২৬৪) বলেন, ছোট একজন সাহাবী। তাঁর মামা আব্দুর রহমান ইবনে আওফ ও ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণনা করেছেন।
তিনি স্বীয় গ্রন্থ তারিখুল ইসলাম (২/৭১৭)-এ আরো বলেন, আব্দুর রহমানের বোন আতিকার ছেলে, (রাসূল সা. থেকে) তার সান্নিধ্য ও বর্ণনা রয়েছে। উমর রাদি. এর সাথে সবসময় থাকেন এবং তার কথা সংরক্ষণ করেন। তিনি উসমান রাদি. এর ঘেরাও থাকাবস্থায় তার পক্ষ থেকে দামেশকের বুরাইদে মুয়াবিয়া রা. এর কাছ এসেছেন। এবং মুয়াবিয়া রা. এর খেলাফতকালে তাঁর এলাকায় এসে অবস্থান করেন। ইয়াজিদের নেতৃত্বকে অপছন্দ করেন এবং আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়েরের মত মক্কায় গিয়ে আত্মগোপন করেন। হাজ্জাজের নেতৃত্বে হুসাইন ইবনে নুমাইর যখন আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইরকে ঘেরাও করে তখন ক্ষেপণাস্ত্রের ছিন্ন পাথর তার ওপরও আঘাত করে।
মৃত্যু:
মিসওয়ার ইবনে মাখরামা (রা.)-এর মৃত্যুর সঠিক সাল নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে হিজরী ৭২, ৭৩ ও ৭৪ বলে কিছু মতভেদ রয়েছে। তবে অধিকাংশ বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি হিজরি ৬৪ সাল মেতাবেক ৬৮৩-৬৮৪ খৃস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ইয়াজিদের শাসনামলে মক্কায় মৃত্যুবরণ করেন এবং তার মৃত্যুর সময় তিনি প্রায় ৬০ বছর বয়সী ছিলেন।
তার মৃত্যু ইসলামের ইতিহাসে একজন প্রজ্ঞাবান সাহাবির গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সমাপ্তি হিসেবে চিহ্নিত। মুসলিম সম্প্রদায় একজন প্রজ্ঞাবান এবং নিষ্ঠাবান সাহাবীকে হারায়। সাথে সাথে ইসলামী সমাজে গভীর শোকের কারণ হয়।
লেখক:
তানজিল আমির
তরুণ আলেম ও দৈনিক যুগান্তরের সহ-সম্পাদক
কনভেনশন গ্রন্থ ২০২৫ থেকে