উম্মে আইমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা একমাত্র নারী যিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার পাশে ছিলেন। তিনি রসূল সাঃ এর ধাত্রী মা। তিনি ৫৫৭ খ্রিস্টাব্দে আবিসিনিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম বারাকাহ্। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতা আব্দুল্লাহ উম্মে আইমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহাকে ক্রয় করে আনেন। তিনি সর্বদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মা বিবি আমেনার খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পিতা আব্দুল্লাহ ব্যবসার কাজে সিরিয়া যাওয়ার কিছুদিন পর আমেনা একটি স্বপ্ন দেখেন; যে তার পেট থেকে একটি আলো বের হয়ে মক্কার আশপাশের সবকিছু আলোকিত করে দিয়েছে। তিনি এই স্বপ্নটি বারাকার নিকট বলেন। তখন তিনি বললেন নিশ্চয়ই আপনি এমন এক সন্তান জন্ম দিবেন যে সকলের জন্য কল্যাণকর হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের পর উম্মে আইমানই প্রথম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কোলে তুলে নেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ছয় বছর বয়সকালে মা আমিনা স্বামী আব্দুল্লাহর কবর জিয়ারতের ইচ্ছা করেন তখন সিরিয়াগামী এক কাফেলার সাথে আমিনা বারাকা ও শিশু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাথে নিয়ে মদিনায় রওনা হন ফেরার পথে তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। আবওয়া নামক স্থানে এসে তার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেলে যাত্রা বিরতি করেন ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বারাকার হাতে তুলে দিয়ে বলেন তুমি আমার সন্তানকে মায়ের মত দেখে রাখবে। সর্বদা তার সাথে থাকবে। তাকে কষ্ট দিবে না। পিতৃহীন শিশু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মায়ের মৃত্যুর সময়ও একমাত্র বারাকা তার সহায় ছিলেন। তিনি মা আমেনাকে সেখানেই কবর দিয়ে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে মক্কা চলে আসেন।
তারপর রাসূল সাঃ এর দাদা আব্দুল মুত্তালিব এর মৃত্যুকালেও বারাকা রাসূল সাঃ এর পাশে ছিলেন বারাকা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা তার পুরো যৌবনে বিবাহ করেননি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেখভাল করার জন্য। তিনি কখনোই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কে ছেড়ে যাননি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহাকে বিবাহের পর বারাকাহ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহাকে ডেকে বলেন আমি তো এখন বিবাহিত কিন্তু আপনি এখনো বিয়ে করেননি আপনার হয়তো এখন বিবাহের চিন্তা করা উচিত। তিনি বলেন আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যাব না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন আপনি আমার জন্য আপনার যৌবন পার করেছেন। এখন আপনার বিয়ে করা উচিত। তখন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা বললেন আমি আপনার জন্য সর্বোত্তম পাত্রের ব্যবস্থা করব এবং বিবাহের সকল খরচ বহন করব। এরপর মদিনার খাজরাজ গোত্রের ওবাইদ ইবনে জায়েদের সাথে বারাকা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা এর বিবাহ হয়। তাদের ঘরে আইমান নামের একজন ছেলে সন্তান হয়। তারপর থেকেই তিনি উম্মে আয়মান নামে প্রসিদ্ধ। কিন্তু কিছুদিন পর তার স্বামী মারা গেলে তিনি পুনরায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরে ফিরে আসেন এবং এখানেই থাকতে থাকেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত লাভের পর খাদিজা রাঃ এর পরে তিনি দ্বিতীয় নারী যিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। একবার মুশরিকরা দারুল আরকামে যাবার পথ অবরোধ করে রাখে। তখন উম্মে আইমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা সেই অবরোধের মধ্যেই খাদিজা রাঃ এর পাঠানো গোপন বার্তা নিয়ে রাসূল সাঃ এর কাছে পৌঁছে দেন। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে আইমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহাকে বলেন আপনি অনেক সৌভাগ্যবান। নিশ্চয়ই আপনি জান্নাতবাসী হবেন। উম্মে আইমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা চলে যাওয়ার পর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি জান্নাতি মহিলাকে বিয়ে করতে চাও তবে তার উচিত উম্মে আইমান কে বিয়ে করা। এ কথা কোনোার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আজাদকৃত দাস ও পালক পুত্র যায়েদ বিন হারেসা বলেন ইয়া রাসূল আল্লাহ, আমি উম্মে আয়মান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহাকে বিবাহ করতে রাজি আছি। অতঃপর যায়েদ বিন হারেসা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর সঙ্গে উম্মে আইমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহার বিবাহ হয়। তাদের ঘরে ওসামা নামের একজন সন্তান হয়েছিল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই ওসামা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে নিজের সন্তানের মতই ভালোবাসতেন এবং স্নেহ করতেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে আইমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহাকেও নিজের মায়ের মতই মর্যাদা দিতেন। তিনি বলতেন আমার মায়ের পরে উম্মে আইমান আমার মা। তিনি তাকে উম্মি, ইয়া উম্মাহ বলে ডাকতেন। মক্কায় মুশরিকদের নির্যাতনের মাত্রা অসহনীয় হয়ে উঠলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদেরকে মদিনা হিজরতের অনুমতি দেন তখন উম্মে আইমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা ও মদিনায় হিজরত করেছিলেন। তখন তার বয়স ছিল ৭০ এরও বেশি ছিল। মক্কা থেকে মদিনা হিজরত তার জন্য তখন ভীষণ কষ্টসাধ্য ছিল। হিজরতের সময় পথিমধ্যে তিনি ভীষণ তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন আর আশপাশে কোনো পানির সন্ধান ও ছিল না। এমন সময় তিনি আকাশ থেকে রশিতে ঝোলানো এক বালতি পানি তার দিকে নামতে দেখেন। সেখান থেকে তিনি পেট পুরে পানি খেয়ে নেন এবং কিছু পানি শরীরেও ঢেলে দেন। তিনি বলেন এরপর আমি কখনোই তৃষ্ণার্ত অনুভব করিনি এমনকি রোজা অবস্থাতেও না।
উম্মে আইমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা যখন মদিনায় পৌঁছলেন তার চেহারা ধুলো মলিন ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখে বললেন, ইয়া উম্মাহ, নিশ্চয়ই আপনি জান্নাতে যাবেন। এভাবে দ্বিতীয়বারের মতো তিনি জান্নাতের সুসংবাদ পেলেন। রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা প্রতিটি যুদ্ধেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে যেতেন। হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন উম্মে আইমান রাদিয়াল্লাহু তা’আলা যুদ্ধে সর্বদা তার চোখ রসূল সাঃ এর উপর রাখতেন। কখনোই তিনি তার নজর সরাতে না। তিনি যুদ্ধের ময়দানে সৈনিকদের সেবা সুশ্রূষা করতেন, তৃষ্ণার্তদের মাঝে পানি বিতরণ করতেন। তিনি ওহুদ যুদ্ধে আনসার মহিলাদের সাথে মুসলিম মুজাহিদের পানি পান করাচ্ছিলেন এমন সময় হিব্বান ইবনে আরাকা তাঁর নিকট একটি তিন নিক্ষেপ করে তখন তার ঝালরের কিছুটা অংশ সরে যায়, তা দেখে সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস কে দিয়ে বলেন এটি ইমরানের নিকট মারো। সাদ তীর টি ছুড়ে মারলেন আর তা হিব্বানের গায়ে লাগে। সে সেখানেই লুটিয়ে পরে ও তৎক্ষণাৎ মারা যায়। এটা দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুখ খুলে হেসে দেন।
সংকলনে:
আতিয়া ফারহা, তাকমিল, রামপুরা জাতীয় মহিলা মাদরাসা
কনভেনশন গ্রন্থ ২০২৫ থেকে