যে পৃথিবী মায়ের আকাশসম মমতার কথা শেখায়, সে পৃথিবীর বুকে ইতিহাস হয়ে আছে অনেক মায়ের বীরত্বগাঁথা কীর্তি। তেমনি এক মায়ের গল্প আমাদের সামনে।
কাদেসিয়ার প্রান্তর। ইসলামের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সেনাপতি ছিলেন সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস। কাফেরদের সেনাপতি ছিল মহাবীর রুস্তম। শত্রুবাহিনীর একলাখ বিশ হাজার সৈনিকের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ত্রিশ হাজার। পারসিকদের বিরুদ্ধে এ ঐতিহাসিক যুদ্ধে মুসলমানদের অর্জিত হয় অভূতপূর্ব এক বিজয়। কাদেসিয়ার প্রান্তরে ত্রিশ হাজারেরও বেশি শত্রুসেনা নিহত হয়। মুসলমানদের শহিদের সংখ্যাও ছিল প্রায় সাড়ে আট হাজার। সকল ঐতিহাসিক একমত কাদেসিয়ার যুদ্ধের মাধ্যমেই মুসলমানদের জন্য পারস্য বিজয় সহজ হয়ে যায়। পৃথিবীর মানচিত্রে বিস্তৃত হতে থাকে ইসলামের জয়যাত্রা। আমরা জানি ইতিহাসের পেছনে থাকে ইতিহাস। গল্পের পেছনেও থাকে কতশত গল্প।
কাদেসিয়ার যুদ্ধে সাড়ে আট হাজারেরও অধিক মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন। এর মধ্যে চারজন সহোদর একই সাথে শহীদ হয়ে অমর হয়ে থাকেন ইতিহাসের পাতায়। আমরা জানব আমাদের সেই বীরদের বীরত্বগাথাঁ কীর্তির পেছনের গল্প।
যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি চলছে সর্বত্রই। যার যার মত করে সামানা প্রস্তুত করছেন সবাই। সেই যুদ্ধে একজন নারীও অংগ্রহণ করেন সৈনিক হিসেবে। বিধবা সেই নারী সাহাবীর বীরত্বের ইতিহাস আজো মুসলিম দুনিয়ার প্ররণার উৎস। যুদ্ধের ময়দানে চার সন্তানকে নিয়ে হাজির সেই মহিয়সী জননী। পুত্ররা যাতে আকাশসম হিম্মত নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করেন। কোনো অবস্থাতেই যেন পিছু না হটে সেজন্য তিনি যুদ্ধের পূর্বে ছেলেদের উদ্দেশ্যে এক মর্মস্পর্শী ভাষণ দেন।
তাঁর অগ্নিঝরা বক্তব্যে বলেন- হে আমার কলিজার টুকরা সন্তানেরা! তোমরা আনন্দচিত্তে ইসলাম গ্রহণ করেছো। নিজ খুশিতেই হিজরত করেছো। সেই খোদার কসম করে বলছি- যিনি ব্যতীত অন্য কোনো মাবুদ নেই- যেমনিভাবে তোমরা এক মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছো, ঠিক তেমনিভাবে তোমরা স্বীয় পিতার সত্য সন্তান। আমি তোমাদের পিতার সাথে ছলনা কিংবা প্রতারণা করিনি। নিজ চরিত্রের দ্বারা তোমাদের মাতুল গোত্রকেও যেমন লাঞ্ছিত করিনি তেমনি কলঙ্কিত করিনি তোমাদের বংশ গৌরবকেও। তোমাদের বংশধারা নিষ্কলুষ, নিষ্কলঙ্ক।
প্রিয় সন্তানেরা! তোমাদের জানা আছে আল্লাহর পথে জিহাদ করার সওয়াব কত বেশি। মনে রেখো, দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী। সকলকে একদিন মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতেই হবে। পক্ষান্তরে আখেরাতের জীবন চিরস্থায়ী। সে জীবন একবার শুরু হলে কখনো তা শেষ হবে না। উপরন্তু দুনিয়ার জীবন অপেক্ষা আখেরাতের জীবন অনেক উত্তম। তাই ভীরু কাপুরুষের মতো মৃত্যুবরণ না করে বীর বাহাদুরের মতো জিহাদের ময়দানে শহীদ হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ ।
স্নেহের ছেলেরা! শোনো, এ হচ্ছে কাদেসিয়ার রণাঙ্গন। কঠিন পরীক্ষার সময় এখন। আগামীকাল সকালে তোমাদের যুদ্ধের ময়দানে যেতে হবে। আমি চাই, তোমরা সাহসিকতার সাথে বীরবিক্রমে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত হও। দুশমনদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য আল্লাহর সাহায্য নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হও। যুদ্ধের লেলিহান শিখা যখন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকবে, তোমরা তখন জীবনের মায়া ত্যাগ করে শত্রু বাহিনীর উপর পঙ্গপালের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়বে। ভীরু কাপুরুষের মতো হিম্মতহারা হয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে আসবে না।
পরদিন যুদ্ধ শুরু হলে মায়ের উপদেশ অনুযায়ী ইসলামের এই সূর্য সৈনিকরা আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তারপর ইতিহাসের পাতায় জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন অসীম শৌর্যবীর্য আর অপরিসীম সাহসিকতার। তাঁদের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় জিহাদের ময়দান। আল্লাহর রাহে শহীদ হন একে একে চার ভাই-ই। সকলেই আস্বাদন করেন শাহাদাতের পিয়ালা । কিছুক্ষণ পূর্বে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। মুসলমানদের বিজয় সূচিত হয়েছে। শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেছে পারস্য সম্রাটের বিশাল বাহিনী। সেই সঙ্গে নিহত হয়েছে পারস্য সম্রাটের অহংকার মহাবীর রুস্তমও।
যুদ্ধ শেষ হলো। ফিরতি কাফেলাকে ঐ মা তাঁর সন্তানদের হালত জিজ্ঞেস করছিলেন। একজন বলল, আপনার সবগুলো পুত্রই শহিদ হয়ে গেছে। হযরত খানসা জিজ্ঞেস করলেন, আঘাত কি তাদের বুকে লেগেছিল, না পিঠে? লোকটি বলল, বুকে। তখন হযরত খানসা বললেন, আল্লাহর শোকর! তিনি আমার সন্তানদেরকে তাঁর রাস্তায় মৃত্যুদান করে আমাকে মর্যাদাবান করেছেন। আমি আল্লাহর কাছে আশা করি তিনি কাল কেয়ামতের ময়দানে আমাদের সবাইকে তাঁর রহমতের ছায়ায় রাখবেন।
সেই শহীদ জননী আর কেউ নন তিনি হজরত খানসা রা. তিনি ছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত এক কবি। কাব্য প্রতিভার খ্যাতি তখন জগৎ জুড়ে। তাঁর কবি প্রতিভার প্রশংসা করতে গিয়ে উসদুল গাবা গ্র্রন্থের রচয়িতা লিখেছেন, সকল ঐতিহাসিক এ ব্যাপারে একমত যে, খানসা (রা.)-এর আগে বা পরে তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ মহিলা কবি আর কেউ ছিল না। উমাইয়া যুগের প্রসিদ্ধ কবি জারীরকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, এ যুগের সবচেয়ে বড় কবি কে? জবাবে তিনি বলেছিলেন, খানসা না হলে আমি হতাম।
খানসার আসল নাম তুমাদির। চালাক-চঞ্চল স্বভাব ও মন কাড়া চেহারার জন্যে খানসা বা হরিণী নামে ডাকা হতো এবং খানসা নামেই ইতিহাসে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। তাঁর পিতার নাম আমর ইবনে শারিদ। তিনি ছিলেন কায়স গোত্রের সুলায়ম শাখার সন্তান। তাদের গোত্র বনু সুলায়ম হিজায ও নাজদের উত্তরে বসবাস করতো। তাদের পরিবার ছিলো অনেক বিত্তশালী। মুলত তাঁর কাব্য প্রতিভা প্রকাশিত হয় তার ভাইদের বিয়োগান্তে শোক প্রকাশের মাধ্যমে। ৬১২ সালে তার ভাই মুয়াবিয়া ইবনে আমর অন্য গোত্রের এক ব্যক্তির হাতে নিহত হন। খানসা চাইতেন যাতে তাঁর আরেক ভাই শাখর ইবনে আমর অন্যজনের হত্যার প্রতিশোধ নেন। শাখর এই প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। এসময় শাখর এক ব্যক্তির তীরে আহত হন এবং আঘাতজনিত কারণে এক বছর পরে মারা যান। খানসা তার ভাই ও সৎ ভাই শাখরের মৃত্যুর পর কবিতায় নিজের শোক ফুটিয়ে তোলেন এবং কবিতার গঠনের কারণে তুমুল খ্যাতি অর্জন করেন।
৬২৯ সালে তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাত করেন ও ইসলাম গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি নবীজিকে স্বরচিত কবিতা পাঠ করে কোনোান। নবীজি সা. তাঁর কবিতা শুনে অভিভূত ও বিস্মিত হন।
আরবি কবিতার সব অঙ্গনেই খানসার বিচরণ ছিল। তৎকালীন আরব সভ্যতার বিভিন্ন উপাদান যেমন- মরুধুলা, ঝড়-বৃষ্টি, উট, পাহাড়-পর্বতের দৃষ্টিনন্দন ক্যানভাস তাঁর কবিতার পঙক্তিতে ফুটে উঠত। ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর কাব্যপ্রতিভা তিনি ইসলামের খেদমতে নিয়োজিত করেন। ইসলাম নিয়ে যেসব কবি ব্যঙ্গাত্মক কবিতা রচনা করত, তিনি কবিতা দিয়েই সেগুলোর জবাব দিতেন।
২৪ হিজরি ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে উসমান (রা.)-এর খিলাফতের শুরুর দিকে বাদিয়া অঞ্চলে এই মহীয়সী নারী কবি ও শহীদ জননী ইন্তেকাল করেন।
লেখক :
আবু মুজাহিদ
আলেম, শিক্ষাবিদ, রাষ্ট্রচিন্তক
কনভেনশন গ্রন্থ ২০২৫ থেকে