বলা হয়ে থাকে তিনি অনেক দীর্ঘাঙ্গী মানুষ ছিলেন। কোনো বর্ণনায় এসেছে প্রায় (৬) ছয় হাত লম্বা ছিলেন। ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি য্দ্ধু ছিলো কাদেসিয়ার প্রান্তরে। এ যুদ্ধে তিনি বীরবিক্রমে লড়েছেন। শুধু কী তাই! তিনি ছিলেন এই লড়াইয়ের প্রাণপুরুষ। সেনাপতি সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের নেতৃত্ব তিনি বীরত্বের সাথে ডান বাহুর দায়িত্ব পালন করেন। জি আপনারা পড়ছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের প্রিয় সাহাবী হজরত জারীর ইবনে আব্দুল্লাহর কথা ।
হজরত জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ ছিলেন আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। জারীর বলেন- ইসলাম কবুলের পরে এমন কখনো হয়নি যে, আমি আমার প্রিয়তম রাসূলের (দ.) সাথে দেখা করতে এসেছি আর তিনি সাক্ষাৎ দেননি। তিনি সব সময় আমাকে ভালবাসতেন, খুব স্নেহ করতেন। তিনি আমাকে দেখলে মুচকি হাসতেন। রাসূল (সা.) আরো বলতেন জারীর! তুমি অনেক সুন্দর! আল্লাহ তায়ালা তোমাকে অনেক সৌন্দর্য দিয়েছেন। এবার তুমি নিজের আখলাকও সুন্দর করো।
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে নবী করীম সা. বলতেন জারীর আমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। সুবহানাল্লাহ!
রাসূল সা. যাকে এতো সম্মান করতেন ভালবাসতেন। আমরা তাঁর গৌরবময় জীবন থেকে কিছু জেনে নিই।
নাম তাঁর জারীর। পিতার নাম আব্দুল্লাহ। তিনি ইয়েমেনে বিখ্যাত ‘বাজীলা’ গোত্রের লোক ছিলেন। ফলে তাঁর নামের সাথে বাজালীও যোগ করা হত, বলা হতো জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ বাজালী। তাঁর উপনাম আবু আমর, কারও মতে আবূ আব্দুল্লাহ। তিনি নিজ গোত্রের একজন মান্যগণ্য নেতা ছিলেন। ছিলেন প্রখর বুদ্ধিমান এবং অসাধারণ রূপবান। তাঁর সৌন্দর্যের কারণে হযরত ‘উমর (রা.) বলতেন, জারীর হচ্ছে এ উম্মতের ইউসুফ। তাঁর জন্মসাল নিয়ে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না।
তাঁর ইসলাম গ্রহণের ইতিহাস নিয়ে কয়েকটি মত আছে। ইবন আব্দুল বার রহ.-এর মতে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের ৪০ দিন আগে ইসলাম গ্রহণ করেন। কিন্তু তার এ মতটি দুর্বল । বুখারী ও মুসলিম শরীফের এক হাদীছে আছে যে, বিদায় হজ্জে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে হুকুম করেছিলেন যে, তুমি মানুষকে চুপ করাও। বিদায় হজ্জ হয়েছে হিজরী ১০ম সালে। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও তিন মাস জীবিত ছিলেন। এর থেকে বোঝা যায় তিনি আরো আগে ইসলাম কবুল করেছেন। ইমাম ওয়াকিদী রহ.-এর বর্ণনানুযায়ী তিনি হিজরী ১০ম সালের রমযানে ইসলাম গ্রহণ করেন। একটি চমকপ্রদ ঘটনার মাধ্যমে জারীর বিন আব্দুল্লাহ ইসলামের সুমহান ছায়াতলে আসেন। তিনি নিজ গোত্রের একদল প্রতিনিধিসহ মদীনা মুনাওয়ারায় আগমন করেন ও ইসলামে দীক্ষিত হন।
ইসলাম গ্রহণের পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ইয়ামানের যুল-খালাসা দেবমন্দির ধ্বংসের জন্য পাঠান। অতঃপর তিনি বিদায় হজ্জে এসে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে যোগদান করেন। কিন্তু হাফেজ ইবনে হাজার রহ. এ মতের ওপরও আপত্তি তুলেছেন। কেননা এক বর্ণনা দ্বারা জানা যায় যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে হাবশার বাদশা নাজাশী রহ.-এর জানাযাও পড়েছিলেন। উল্লেখ্য যে, নাজাশীর মৃত্যু হিজরী ১০ সনের আগেই হয়েছিল।
বিভিন্ন গ্রন্থে এভাবেও বর্ণিত আছে যে, তিনি নিজ গোত্রের ১৫০ জন লোকসহ মদীনা মুনাওয়ারায় আগমন করেন। মসজিদে নববীর কাছাকাছি পৌঁছে তিনি উটের পিঠ থেকে নেমে যান। তারপর পোশাক বদলে মসজিদে প্রবেশ করেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি প্রবেশ করতেই লোকজন চোখের কোণ দিয়ে তাকে দেখতে থাকেন। তিনি তার পার্শ্ববর্তী একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর বান্দা! তোমরা আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছ কেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি আমার সম্পর্কে কিছু বলেছেন? লোকজন জানালেন- হাঁ, তিনি তোমার প্রশংসা করেছেন। ভাষণের মাঝখানে তিনি বলে উঠেন, শীঘ্রই তোমাদের কাছে এই পথ দিয়ে ইয়ামানের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি এসে পৌঁছাবে। কোনো হে! তার চেহারায় ফিরিশতার স্পর্শ আছে।
একথা শুনে তিনি আল্লাহর শোকর আদায় করেন। তিনি মসজিদে ঢুকলে তার বসার জন্য একটি বালিশ ছুঁড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি মাটিতে বসে পড়লেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি- তুমি কখনও পৃথিবীতে সীমালঙ্ঘন করবে না এবং ফিতনা-ফাসাদ বিস্তার করবে না।
আগেই বলা হয়েছে তিনি অত্যন্ত রূপবান ছিলেন। হযরত উমর রা. বলতেন, তারচে’ সুন্দর কোনোও লোক আমি কখনও দেখিনি। হাঁ, হযরত ইউসুফ আলাইহিস- সালাম সম্পর্কে আমরা যা শুনেছি তা আলাদা কথা। এতটা রূপের সাথে বুদ্ধিমত্তার মিলন সাধারণত হয় না। কিন্তু হযরত জারীর (রা.)-এর ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এজন্য তার প্রতি সীমাহীন মুগ্ধ ছিলেন।
তাঁর বুদ্ধিমত্তার একটি মজার ঘটনা আছে। একবার হযরত ‘উমর ফারক রা.-এর মজলিসে কারও ওযু ছুটে গেল। কিন্তু ঠিক কার তা জানা যাচ্ছিল না। হযরত উমর রা. বললেন- যে ব্যক্তি কাজটি করেছে তাকে হুকুম দিচ্ছি, উঠে গিয়ে ওযূ করে আসুক। কিন্তু কেউ উঠছিল না। ভর মজলিশে এটি লজ্জারও বিষয়। শেষে হযরত জারীর রা. বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনি বরং আমাদের সকলকেই ওযূ করে আসতে হুকুম করুন। তিনি বললেন, হাঁ, ঠিক আছে, আমি নিজেকেও আদেশ করছি এবং তোমাদেরকেও আদেশ করছি। সুতরাং সকলেই উঠে গিয়ে ওযূ করে আসল। হযরত “উমর রাযি, মন্তব্য করলেন, হে জারীর! আপনি ইসলামের আগেও একজন ভালো নেতা ছিলেন এবং ইসলামী জীবনেও একজন ভালো নেতা হিসেবেই আছেন।
কোনোও বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দিকে নিজ গায়ের চাদর ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলেন, হে আবূ আমর! তুমি এটা নাও এবং এর ওপর বস। কিন্তু তিনি সেটি নিজ বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ তা’আলা আপনাকে সম্মানিত করুন, যেমন আপনি আমাকে সম্মান দেখিয়েছেন।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, তুমি কি যুল-খালাসার ব্যাপারে আমাকে শান্তি দেবে? যুল-খালাসা ছিল ইয়ামানের খাস‘আম গোত্রীয় দেবমন্দির, যেটিকে ইয়ামানের কা’বা বলা হত। হযরত জারীর রা. দেবমন্দিরটি ধ্বংস করতে মনস্থির করে ফেললেন। কিন্তু তিনি ঘোড়ার পিঠে স্থির হয়ে বসতে পারতেন না। তিনি বিষয়টা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উল্লেখ করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বুকে হাত রেখে দু’আ করলেন, হে আল্লাহ! তুমি তাকে বানিয়ে দাও হিদায়াতকারী ও হিদায়াতপ্রাপ্ত। তাঁর দু’আয় হযরত জারীর (রা.)-এর সে সমস্যা কেটে গেল। তিনি নিজ গোত্রের ১৫০ জন লোক নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তিনি মন্দিরটি ধ্বংস করলেন এবং দেবী খালাসাকে আগুনে পুড়ে ফেললেন। তারপর এ সুসংবাদ মদীনা মুনাওয়ারায় পাঠিয়ে দিলেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বাহিনীর জন্য পাঁচবার বরকতের দু’আ করলেন।
নবী প্রেমের উজ্জল ঘটনাও রয়েছে তাঁর কারনামায়। হজরত জারীর একদিন তাঁর গোলামকে পাঠালেন একটি ঘোড়া কিনে আনার জন্য। গোলাম ৩০০ দিরহামে একটি ঘোড়া কিনে আনেন। সাথে নিয়ে আসেন বিক্রেতাকেও। হজরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু ঘোড়াটি দেখে বুঝতে পারলেন। বিক্রেতা দাম কম চেয়ে ঠকেছে। জারীর মনে মনে স্থির করলেন, ন্যায্য দামেই তিনি ঘোড়া কিনবেন। বিক্রেতার কাছে জানতে চাইলেন, ‘ঘোড়াটি ৪০০ দিরহাম বিক্রি করবে কিনা? বিক্রেতা তাতে রাজি হলো। হজরত জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন- ঘোড়ার দাম ৫০০ হলে কেমন হয়? তিনি ঘোড়াটির দাম বৃদ্ধি করতে করতে শেষ পর্যন্ত ৮০০ দিরহাম মূল্যে কিনে নিলেন।
হজরত জারীর ইবনে আব্দুল্লাহর কাছে জানতে চাওয়া হলো, তিনি কেন ঘোড়াটির মূল্য এভাবে বাড়িয়ে ছিলেন। তিনি বললেন- ঘোড়াটির প্রকৃত দাম সম্পর্কে বিক্রেতার সঠিক ধারণা ছিল না। তাই তিনি ঘোড়াটির সঠিক মূল্য দিয়েছেন। আর এর কারণ বর্ণনা করে তিনি বলেছিলেন-‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি, আমি সবসময় সব মুসলমান ভাইয়ের কাছে তাদের জন্য অকপট ও শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে থাকবো।
রাসূলের (দ.) একজন প্রিয় সাহাবী। তিনি যুবক বয়সে ইসলাম কবুল করে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। একদিকে ছিলেন প্রচন্ড বিনয়ী, আবার শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয়ী সিপাহসালার।খুবই তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী আবার নবীজীর আদর্শের একজন যোগ্য সৈনিক। জীবনের সবকিছুতেই ইসলামকে প্রাধান্য দিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন ইসলামের সোনালী ইতিহাসে। হযরত জারীর রা. অত্যন্ত বিনয়ী ও পরোপকারী লোক ছিলেন। হযরত আনাস ইবন মালিক রা. বলেন- জারীর (রা.) আমার খেদমত করতেন, অথচ তিনি আমার চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন।
তিনি পরবর্তী জীবনে প্রথমে কুফায় এবং তারপর করকীসিয়ায় বসবাস করেন। তিনি শারাত নামক স্থানে হিজরী ৫১ সালে ইন্তিকাল করেন, কারও মতে ৫৪ সালে। তার সূত্রে ১০০টি হাদীস বর্ণিত রয়েছে।
লেখক
মুফতী হুসাইন মুহাম্মাদ কাওসার বাঙালী
কনভেনশন গ্রন্থ ২০২৫ থেকে